বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে গত ২১ জুলাই সোমবার বিধ্বস্ত হয়ে শ্রেণিকক্ষের ভেতরে ঢুকে পড়ে। ফাইল ছবি
নিজস্ব প্রতিবেদক ।।
রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় গতকাল শুক্রবার আরও দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) তারা চিকিৎসাধীন ছিল। এ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ৩৩ হয়েছে। গতকাল মারা যাওয়া দুই শিক্ষার্থী হলো আব্দুল মুসাব্বির মাকিন (১৩) ও আফরোজ আইমান (১০)। মুসাব্বির মাইলস্টোন স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। আফরোজ পড়ত স্কুলের চতুর্থ শ্রেণিতে।
বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় এ নিয়ে বার্ন ইনস্টিটিউটে ১৫ জন মারা গেল। গতকালের দুজনের মৃত্যুর বিষয়ে বার্ন ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক শাওন বিন রহমান মিডিয়াকে বলেন, মুসাব্বিরের শরীরের ৭০ শতাংশ এবং আফরোজের শরীরের ৪৫ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গতকাল রাত পর্যন্ত মোট নিহতের সংখ্যা ছিল ৩৩। এর মধ্যে দুজন ছাড়া বাকিদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে তিন শিশু ও দুই অভিভাবকের পরিচয় নিশ্চিত হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
গতকাল বিকেল সোয়া চারটা পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, বার্ন ইনস্টিটিউটে ৪০ জন চিকিৎসাধীন আছেন। এ ছাড়া তিনটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ১০ জন। এর মধ্যে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ৮ জন, শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন এবং জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে একজন ভর্তি আছেন। সেই হিসাবে আহতদের মধ্যে এখনো হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৫০ জন।
জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন আহতদের বিষয়ে গতকাল বিকেলে ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক নাসির উদ্দীন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন পাঁচজনের অবস্থা ক্রিটিক্যাল (সংকটাপন্ন)। তাঁদের আইসিইউতে রাখা হয়েছে। তাঁদের চেয়ে একটু কম গুরুতর অর্থাৎ সিভিয়ার ক্যাটাগরিতে রয়েছেন ১০ জন। আর ইন্টারমিডিয়েট (মাঝারি) ক্যাটাগরিতে পোস্ট অপারেটিভে রাখা হয়েছে ১০ জনকে। আরও ১৫ জন বার্ন ইনস্টিটিউটের কেবিনে আছেন।
অবস্থার উন্নতিও হয়েছে
বার্ন ইনস্টিটিউট সূত্র জানিয়েছে, যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় অগ্নিদগ্ধদের চিকিৎসায় বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা কাজ করছেন। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সিঙ্গাপুর, চীন ও ভারতের চিকিৎসা দল। প্রতিদিনই তাঁদের সঙ্গে দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নানা বিষয়ে অভিজ্ঞতা বিনিময় হচ্ছে। বিদেশি চিকিৎসকেরাও রোগীদের দেখছেন। সব মিলিয়ে দগ্ধ হয়ে যাঁরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন, তাঁদের কারও কারও শারীরিক অবস্থার উন্নতিও হয়েছে।
এ বিষয়ে বার্ন ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক নাসির উদ্দীন গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, একটি ভালো খবর যে কয়জনকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল। তাঁদের থেকে দুজনের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তাঁদের ভেন্টিলেটর খুলে ফেলা হয়েছে। তাঁরা নিজে নিজে শ্বাস নিতে পারছেন। শনিবার (আজ) চার থেকে পাঁচজন রোগীকে ছুটি (ছাড়পত্র) দেওয়া যাবে।
রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের স্থানটি দেখতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ফটকে গতকালও উৎসুক জনতার ভিড় দেখা গেছে। পাঁচ-সাত মিনিট পরপর ৮-১০ জনকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে গিয়ে এই দৃশ্য দেখা গেছে।
গত সোমবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির একটি ভবনে বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। এতে হতাহতের ঘটনা ঘটে। এর পর থেকে সেখানে উৎসুক মানুষের ভিড় লেগে আছে। তবে গত বুধবার ও গত বৃহস্পতিবার এমন মানুষের প্রবেশ বন্ধ রেখেছিল কলেজ কর্তৃপক্ষ। ণমাধ্যমকর্মীদেরও প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।
তবে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে স্কুলের সামনে গিয়ে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। কলেজের প্রধান ফটকে থাকা নিরাপত্তারক্ষীরা উৎসুক লোকজনকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছিলেন। তবে গণমাধ্যমকর্মীদের গতকালও কলেজের ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।
প্রধান ফটকে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক ব্যক্তি বলেন, সাধারণ মানুষকে আর কতক্ষণ আটকে রাখা যায়। কর্তৃপক্ষ গতকাল (বৃহস্পতিবার) সকালে বলেছে, অল্প অল্প করে লোকজনকে প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশের সুযোগ দিতে। তারা ৪ নম্বর ফটক দিয়ে বেরিয়ে যাবে। তবে মিডিয়াকে ঢুকতে দিতে নিষেধ করা হয়েছে।
ভেতরে ঘুরে এসেছেন এমন একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দোতলা যে ভবনে বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে, সেটির সামনের খোলা জায়গা টিন দিয়ে বেড়া দেওয়া হয়েছে। ভেতরে ঢোকার জন্য বেড়ার মাঝে ছোট একটি ফটক রাখা হয়েছে। ভেতরে ঢুকে কেউ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার স্থানের ছবি তুলছেন, কেউ ভিডিও করছেন। স্থানটি দেখা শেষ হলে উৎসুক লোকজনকে দ্রুত চলে যেতে বলছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা।
বিকেলের দিকে উৎসুক জনতার ভিড় বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে বিকেল পাঁচটার দিকে তাঁদের প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়। লোকজন তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ফটকের সামনে জড়ো হয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করেন। এ সময় ফটকে কেউ কেউ আঘাতও করেন। এরপর স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ফটক থেকে কিছুটা দূরে রাস্তার ওপর একটি বাঁশ আড়াআড়ি করে ধরে রেখে উৎসুক জনতাকে আটকে রাখার চেষ্টা করেন।
ট্রমায় ভুগছে মাইলস্টোন স্কুলের শিক্ষার্থীরা
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম আবার শুরু করার বিষয়টি চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করছেন অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জিয়াউল আলম। তিনি গতকাল এক গণমাধ্যম কর্মীকে বলেন, শিক্ষার্থীদের সামনেই বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা ঘটেছে। শিক্ষার্থীরা এখনো ট্রমায় ভুগছে।
অধ্যক্ষ বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি কয়েক দিন বন্ধ রাখায় শিক্ষা কার্যক্রমে ছেদ পড়েছে বলে, শিক্ষা কার্যক্রমে যে ছেদ পড়েছে, সেটা পূরণ করে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফেরানো বড় চ্যালেঞ্জ। এ জন্য শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিং করাসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।