বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো যেন নিয়মেই পরিণত হয়েছে, সড়কে মৃত্যুর মিছিল অনবরত চলছেই

road-accident.jpg

বিশেষ প্রতিবেদকঃ

বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো যেন নিয়মেই পরিণত হয়েছে। চালকের অদক্ষতা এবং ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চলাচলের কারণে দুর্ঘটনার সংখ্যা যে বাড়ছে তা বলাই বাহুল্য। অবস্থা এতটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে, একজন যাত্রী ঘর থেকে বের হয়ে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবেন কিনা অথবা দৈনন্দিন কাজ শেষ করে নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারবেন কিনা- এ নিয়ে প্রতি মুহূর্তে উদ্বেগের মধ্যে থাকতে হয় পরিবারকে।

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে এত আলোচনার প্রেক্ষাপটে যান্ত্রিক যানের চালকরা ন্যূনতম সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন- এমন দৃষ্টান্ত বিরলই বলা চলে। বরং দেশে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন এবং আহত হচ্ছেন। তারপরও বাস ও ট্রাকের চাপায় মৃত্যুর মিছিল অব্যাহত রয়েছে। অকালে ঝরে পড়ছে অনেক সম্ভাবনাময় জীবন।

পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষকে হারিয়ে কত পরিবার পথে বসেছে এবং কত মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে অসহায় জীবনযাপন করছেন তাদের খোঁজখবর আমরা ক’জনই বা রাখি। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু মেনে নেওয়া কঠিন। একটি দুর্ঘটনা একটি পরিবারকে পথে বসিয়ে দেয়। স্বজন হারানোর বেদনা সারা জীবন বইতে হয়। প্রিয়জন হারানোর কষ্টের কোনো বর্ণনা হয় না; যে হারায় কেবল সেই বোঝে।

এক একটি সড়ক দুর্ঘটনা যে পরিবারের কান্না, তা পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে কতটা মানবিক সহানুভূতি জাগায় তা আমরা অনেকেই জানি না। তাহলে কি এই অনিয়ম, দুর্বৃত্তাচার, যথেচ্ছার, মৃত্যুর প্রতিযোগিতা চলতেই থাকবে?

সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো অনেক আগেই শনাক্তকৃত। কী করলে দুর্ঘটনা ও মৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব তা বিশেষজ্ঞরা বহুবার বলেছেন। তারপরও কিছু হচ্ছে না! আমরা বিশ্বাস করি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সচেতন, তৎপর ও দায়িত্বশীল হলে সড়ক দুর্ঘটনার অভিশাপ থেকে দেশকে একেবারে মুক্ত করা সম্ভব না হলেও দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা কমিয়ে আনা অবশ্যই সম্ভব।

এদিকে, সড়ক পরিবহন শ্রমিক সংগঠনগুলো নিজেদের ‘ঘাতক নয়, জনগণের সেবক’ দাবি করে থাকলেও তাদের বাস্তব কর্মকান্ড কি তা প্রমাণ করে? স্বীকার করা হচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য একতরফা বাস চালকদের দায়ী করা সমীচীন নয়! পথচারীদের অসতর্কতা, দায়িত্বহীনতার পাশাপাশি ক্রটিপূর্ণ সড়কপথও দুর্ঘটনার জন্য বহুলাংশে দায়ী। এর পাশাপাশি হাইওয়েতে স্কুটার, নসিমন, করিমন, রিকশাভ্যানসহ ধীরগতির যানবাহন চলাচলও দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। সেই সাথে পরিবহন মালিকদের অতিমুনাফার লোভ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর উদাসীনতার কারণে ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালাতে বাধ্য হন পরিবহন চালকরা। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য এটিও একটি কারণ।

তাছাড়া খরচ কমানোর জন্য বেশির ভাগ পরিবহন মালিক শ্রম আইনে বর্ণিত কাজের সময়সীমা না মেনে পরিবহন শ্রমিকদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮ ঘণ্টা কাজ করিয়ে থাকেন। ক্লান্ত ও অবসন্ন বাস চালকরা অনেক সময় অসাবাধনতাবশত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে থাকেন।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পথচারীদের অসতর্কতা, পরিবহন শ্রমিকদের অসাবধানতা, এগুলো দুর্ঘটনার একেকটি কারণ, এ বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, জনগণকে সচেতনতা হওয়া, এটা অন্তত খুবই জরুরি একটা বিষয়। এর সাথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী (সড়ক নিরাপত্তায় যারা নিয়োজিত) তাদের দায়িত্বশীলতা আরও কঠোর অবস্থান নিতে হবে। এর পাশাপাশি পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্য অনিয়ম-দুর্নীতির কারণেই সড়কে যে ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলছে এগুলো বন্ধ করতে হবে। কেননা, এ যানবাহনের অধিকাংশ চালকই অদক্ষ, অসচেতনতা। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের দক্ষ চালক গড়ে তোলার কর্মসূচির প্রতি গুরুত্বারোপ দেওয়া হলেও এখন সে কার্যক্রম একেবারেই নেই বললেই চলে।

সরকারের পক্ষ থেকে যদি দক্ষ চালক কর্মসূচির দিকে একটু বেশি গুরুত্বারোপ করা হয় তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকটাই কমে আনা সম্ভব। বর্তমান সময়ে কুয়াশার কারণে গাড়ি আইলেনে উঠে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে। সরকার ফিটনেসের দিকে নজর দিলেও এ দিকে বেশি নজর দিচ্ছে না। এ কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে। সড়ক বিভাগের তদারকি জোরদার করা দরকার।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ সাল থেকে সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য মতে, বিগত ৫ বছরে ২৬ হাজার ৯০২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৭ হাজার ১৭০ জন নিহত ও ৮২ হাজার ৭৫৮ জন আহত হয়েছে। তবে সংঘটিত দুর্ঘটনার সিংহভাগই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় না। যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিগত ২০১৫ সালে ৬ হাজার ৫৮১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৬৪২ জন নিহত ও ২১ হাজার ৮৫৫ জন আহত হয়েছে। ২০১৬ সালে ৪ হাজার ৩১২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৫৫ জন নিহত ও ১৫ হাজার ৯১৪ জন আহত হয়েছে। ২০১৭ সালে ৪ হাজার ৯৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৩৯৭ জন নিহত ও ১৬ হাজার ১৯৩ জন আহত হয়েছে। ২০১৮ সালে ৫ হাজার ৫১৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ২২১ জন নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছে ১৫ হাজার ৪৬৬ জন। ২০১৯ সালে ৫ হাজার ৫১৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৮৫৫ জন নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছে ১৩ হাজার ৩৩০ জন ।

এ বিষয়ে পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব এনায়েত উল্লাহ বলেন, গাড়ি চালানো বাস্তবে বড়ই কঠিন, একজন চালককে গাড়ি চালানোর বিষয়ে সব ধরনের সাবধানতার বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়। এর পরও মাঝেমধ্যে দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। কোনো চালক নিজের ইচ্ছায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটানোর পক্ষে নয়। সাবধান থাকার পরেও দুর্ঘটনা ঘটছে। এটা একান্তই দুর্ঘটনা। তিনি বলেন, কড়াকড়ির কারণে এখন দুর্ঘটনা কমেছে।

scroll to top