ধর্মের নামে ছুতো সাজিয়ে আর কত

image-240360.jpg

এ আর চন্দন ::

কক্সবাজারের রামুতে শুরু, এরপর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, রংপুরের গঙ্গাচড়া, সিলেটের ওসমানীনগর, ভোলার বোরহানউদ্দিন আর সর্বশেষ লালমনিরহাটের বুড়িমারী- সবখানে একই ধরনের কৌশল, একই ধরনের ছক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী কারো ফেসবুক আইডি হ্যাক করে উসকানিমূলক ছবি বা লেখা পোস্ট করে ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয়। আগের ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে অপশক্তির ষড়যন্ত্র প্রকাশ পেতে সময় লাগলেও ভোলায় তা ধরা পড়ে তাৎক্ষণিকভাবে। তবু থেমে থাকেনি উন্মাদনা। সম্প্রতি লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারীতে পবিত্র কোরআন অবমাননার গুজব রটিয়ে আবু ইউসুফ শহিদুন্নবী জুয়েলকে পিটিয়ে হত্যার পর তার লাশ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের কাছে জমা দেওয়া এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুয়েলের বিরুদ্ধে কোরআন অবমাননার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ওই এলাকায় এ ধরনের ঘটনা আগেও ঘটানো হয়েছে বলে খবর মিলছে। স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে এমন তথ্যও মিলছে যে, এলাকাটি একসময় জামায়াতের ঘাঁটি হিসেবে গণ্য হতো।

গত শনিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর পুলিশের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের প্রত্যেককে আমরা খুঁজে বের করব এবং যার জন্য যতটুকু শাস্তি প্রযোজ্য, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ ঘটনাটি পরিকল্পিত হত্যাকা- কি না জানতে চাইলে ডিআইজি বলেন, ‘আমরা মনে করি, এ ঘটনায় কারো না কারো ইন্ধন রয়েছে। না হলে এমন একটা তুচ্ছ ঘটনা, যেটা কি না ঘটনাই নয়, সেটা নিয়ে এমন বড় কিছু হওয়ার কথাই নয়। যারাই থাকুক ঘটনার সামনে কিংবা পেছনে, তাদের খুঁজে বের করা হবে।’

ভোলার ঘটনায় পুলিশ শুরুতেই জানিয়েছিল, তারা এটি উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে যে বোরহানউদ্দিনে বিপ্লব চন্দ্র শুভ নামের এক হিন্দু তরুণের বিরুদ্ধে হজরত মোহাম্মদ (সা.)-কে অবমাননার অভিযোগ তোলা হলেও প্রকৃতপক্ষে সেটি করেন দুজন মুসলিম। ওই হিন্দু তরুণ আগেই তার আইডি হ্যাকড হওয়ার কথা পুলিশকে জানিয়ে জিডি করেছিলেন থানায়। পুলিশ তদন্ত করে এর সত্যতা পেয়ে ওই অপকর্মে জড়িত দুই মুসলিম ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারও করেছিল। স্থানীয় আলেম-উলামা ও গণমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের আলোচনায় বিষয়টি মিটেও গিয়েছিল এক রকম। ‘ধর্ম অবমাননার প্রতিবাদে’ সাধারণ মুসল্লিদের ডাকা বিক্ষোভ-সমাবেশের কর্মসূচিও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু এর পরও ৩০ থেকে ৪০ জন ‘অচেনা ব্যক্তি’ গিয়ে হঠাৎ পুলিশের ওপর চড়াও হয়। তারা এই বলে গুজব ছড়িয়ে দেয় যে কর্মসূচির নেতৃত্ব দেওয়া আলেমদের পুলিশ আটক করেছে। স্থানীয় সংবাদকর্মীদের ধারণ করা একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, হঠাৎ একদল যুবক পুলিশের ওপর আক্রমণ করে। পুলিশ কর্মকর্তারা তখন বোরহানউদ্দিনের ঈদগাহ মসজিদের দোতলায় আশ্রয় নিলে সেখানে দরজা-জানালা ভেঙে তাদের মারধর করা হয়। পুলিশ গুলি ছোড়ার আগেই বাইরে থেকে গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। ওই গুলিতেই এক পুলিশ সদস্য আহতও হন। হামলাকারীরা পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল যে ভোলার পুলিশ সুপার ঢাকায় অবস্থানরত স্থানীয় সংসদ সদস্যকে ফোন করে তার সাহায্য কামনা করেছিলেন।

স্থানীয় সংসদ সদস্য আলী আজম মুকুল বিবিসি বাংলাকে বলেন, কয়েক দিন আগে থেকে তিনি ঢাকায় থাকলেও ওই ফেসবুক পোস্ট নিয়ে বোরহানউদ্দিনে পরিস্থিতি যে উত্তপ্ত হচ্ছিল, তার সব খবরই ফোনে পাচ্ছিলেন এবং প্রশাসনকে আলেম-উলামাদের সঙ্গে বৈঠক করারও নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু এর পরদিন (রোববার) ঈদগাহে কথিত ‘তৌহিদি জনতা’র ব্যানারে কয়েক হাজার মানুষ সমাবেশ করে এবং একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। সংসদ সদস্য বলেন, জেলার পুলিশ সুপার তিনি ফোন রেখে দেওয়ার আগে আমাকে শেষ কথাটা বলেন, ‘স্যার আমাদের বাঁচান। আমরা মসজিদের দোতলায় ইমামের রুমে অবরুদ্ধ হয়ে আছি, আমাদের বাঁচান’, তার উক্তি ছিল এটাই।

এত কিছুর পরও দমে যায়নি চক্রান্তকারীরা। সেবার সম্ভবত ধর্মীয় উন্মাদনা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার ছক ছিল তাদের। কিন্তু তাদের কৌশল শুরুতেই ধরা পড়ে যাওয়ার পর নতুন ছক কষেছিল তারা। পুলিশের ওপর হামলা, গুলি কিংবা পাল্টা গুলিতে চারজনের প্রাণহানির ঘটনাকে পুঁজি করে নতুনভাবে স্থানীয় জনতাকে মাঠে নামানো হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, পুলিশকে তারা বাধ্য করে প্রকৃত ধর্ম অবমাননাকারী মুসলমানদের সঙ্গে যার ফেসবুক আইডি হ্যাক করে তারা অপকর্মটি করেছিল সেই বিপ্লব চন্দ্র শুভকেও একই মামলার আসামি করতে। কোনো অপরাধ না করেও (পুলিশের ভাষ্য মতেই) বেচারা বিপ্লবকে অপরাধীদের সঙ্গে জেলহাজতে থাকতে হয়েছিল। আর যে চারজনের প্রাণহানি ঘটেছিল, তাদের পোস্টমর্টেমও করতে দেয়নি তথাকথিত তৌহিদি জনতা। স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহ জাগে, ওই চারজন আসলে কাদের গুলিতে মারা গিয়েছিলেন?

ভোলায় ধর্ম অবমাননার অজুহাতটি যে সাজানো নাটক ছিল, তা স্পষ্ট হওয়ার পরও দেশের এক শ্রেণির রাজনীতিক, এমনকি তথাকথিত কিছু সুধিজন সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার না হয়ে উল্টো পুলিশ ও সরকারের দিকে আঙুল তুলছেন।

ফেসবুক ব্যবহার করে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে একই কৌশলে হিন্দু বা বৌদ্ধদের বাড়িঘরে হামলার ঘটনা ঘটেছে আগেও। ২০১২ সালে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধদের বাড়িঘর ও বৌদ্ধবিহারে হামলার ঘটনা পুরো দেশকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছিল। তখনো ফেসবুকে নাম যুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একজনের। উত্তম বড়–য়া নামে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের এক যুবকের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে কোরআন অবমাননার ছবি ট্যাগ করে দিয়েছিল কেউ। এরই জেরে রামুতে ১০টিরও বেশি বৌদ্ধবিহার এবং প্রায় ২৫টি বাড়িতে হামলা চালানো হয়েছিল। কিন্তু উত্তম বড়–য়া নামের ওই তরুণের আর খোঁজ মেলেনি এবং হামলার ঘটনায় কারো কোনো শাস্তি হওয়ারও খবর পাওয়া যায়নি।

রামুর কায়দায়ই হামলা চালানো হয়েছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর। তবে সেখানে আক্রান্ত হয়েছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। অভিযোগও সেই পুরোনো- ফেসবুকে ইসলামবিদ্বেষী ছবি। এজন্য প্রচার করা হয়েছিল রসরাজ নামে এক হিন্দু ব্যক্তির নাম। তাকে পিটিয়ে পুলিশেও দেয় স্থানীয় বাসিন্দারা। তবে ঘটনা তাতে থেমে যায়নি। পরে ধর্মভিত্তিক কয়েকটি সংগঠন বিক্ষোভ সমাবেশ ডাকে এবং সেখান থেকেই হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা করা হয়। ভাঙচুর করা হয় প্রায় ৩০০ বাড়ি। অথচ আড়াই মাস পর জেল থেকে বেরিয়ে রসরাজ জানান, তিনি ফেসবুক চালাতে পারেন না। এমনকি এর যে পাসওয়ার্ড বলে একটি বিষয় আছে, সে বিষয়েও তার কোনো ধারণাই নেই। নাসিরনগরের ঘটনায়ও আসল রহস্য আর সামনে আসেনি। এলে হয়তো পরের অঘটন ঘটানো কঠিন হতো।

নাসিরনগরে হামলার এক বছর পর রংপুরের গঙ্গাচড়ায় ফেসবুক থেকে ছড়ানো গুজবের জের ধরে একজনের মৃত্যু হয়েছিল। গঙ্গাচড়ায় কয়েক দিন মাইকিং করে হামলা চালানো হয়েছিল হিন্দুদের বাড়িঘরে।

গত জুন মাসে ঈদের নামাজের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা হয়েছিল সিলেটের ওসমানীনগরে। সনাতন ধর্মের এক নারীর মৃত্যুর পর সৎকার নিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তির নামে ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলে এমন কিছু পোস্ট দেওয়া হয়েছিল, যা নিয়ে মুসলমানদের একাংশ ক্ষোভ প্রকাশ করে। তখনো কয়েকটি বাড়িতে হামলা চালানো হয়।

আগের প্রতিটি ঘটনায়ই কুশীলবরা থেকে গেছে আড়ালে। পরিস্থিতি শান্ত করেই যেন হাঁফ ছেড়েছে পুলিশ, প্রশাসন ও সরকার। এবারো কী তারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে! সূত্র : প্রতিদিনর সংবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top