ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীঃ একজন লড়াকু মানুষের প্রতিকৃতি

102322994_1101512116890465_7925347074093552408_n.jpg

জিয়া খন্দকার

নীতি নৈতিকতা, আদর্শিক চেতনা, সততা ও দেশ প্রেমে বলীয়ান দৃঢ় চিত্তের অধিকারী নির্মোহ ও নির্লোভ মানুষের অন্যতম ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতো মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। দেশ ও মানব কল্যানে নিজেকে উৎসর্গ করা আজীবন লড়াকু মানুষের জীবন্ত প্রতিকৃতি ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাষ্টি ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী মূলত লড়াই শুরু করেছেন সেই ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। তখন তিনি এমবিবিএস পাশ করে লন্ডনে এফআরসিপিএস করছেন। কিছু দিন পর তাঁর ফাইনাল পরীক্ষা। এমনই সময় দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয় গেলো। উচ্চতর ডাক্তারি পড়া বাদ দিয়ে প্রথমে তিনি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারণা ও মুক্তিযুদ্ধের জন্য তহবিল সংগ্রহ করতে থাকেন। এক পর্যায়ে তিনি ভারতে চলে আসেন এবং সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সাথে যোগাযোগ করেন। তাঁর ইচ্ছে ছিলো সম্মুখ সমরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধে লড়াই করবেন।

কিন্তু তিনি যখন দেখলেন সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করতে গিয়ে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে, কোনো চিকিৎসা পাচ্ছেনা, পেলেও তা নিতান্তই অপ্রতুল, তখন তিনি মত পরিবর্তন করে আহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নিলেন। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সাথে আলোচনা করে ভারতের আগরতলা রাজ্যের মেলাঘরে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য প্রতিষ্ঠা করলেন ৪৮০ শয্যা বিশিষ্ট বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল। ছনের ছাউনি, বাঁশের বেড়া, ডাক্তার, নার্স, ঔষধ, চিকিৎসা সামগ্রী, খাদ্য ইত্যাদির অভাব সত্বেও পর্যায়ক্রমে একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল হিসেবেই যুদ্ধকালিন পুরো সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দিয়েছে ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ও তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত রণাঙ্গনের এই বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল। অনেক অপেশাদার তরুণ ও ছাত্র ছাত্রীকে স্বল্প প্রশিক্ষণ দিয়ে তিনি এ হাসপাতালের সাথে জড়িত করেছিলেন। তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এডভোকেট সুলতানা কামালও তাদের মধ্যে অন্যতম।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তিনি ভাবলেন সাধারণ মানুষের চিকিৎসা সহজলভ্য করার জন্য এ হাসপাতালকে কিভাবে কাজে লাগানো যায়। ভাবনা অনুযায়ী তিনি কুমিল্লায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন।
পরবর্তীতে এটাকে আরো বৃহত্তর আকারে রূপ দেয়ার চিন্তা করেন এবং বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে তাঁর পরিকল্পনার কথা জানান। বঙ্গবন্ধু তাঁকে ঢাকার নয়ার হাট অঞ্চলে প্রয়োজনীয় জমি বরাদ্দ দেন। বর্তমানে যেখানে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও গণবিশ্ববিদ্যালয় ও গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যাল রয়েছে সে জায়গা।

সম্ভবত সত্তরের দশকে তৎকালীন দেশ সেরা সাপ্তাহিক বিচিত্রার কোনো এক সংখ্যায় ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে নিয়ে একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিলো। তখন তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে মনে মনে তাঁর ভক্ত বনে গিয়েছিলাম। অবশ্য এর আগেও তাঁর সম্পর্কে জানতাম, তবে এতো বিস্তারিত নয়। এর আগে অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলায় তাঁর বিষয়ে একাধিক প্রতিবেদন পড়েছিলাম। সেই থেকে তাঁর সাথে সাক্ষাতের, আলোচনা করার একটা ইচ্ছে মনের মধ্যে পুষে আসছিলাম। আশির দশকে তাঁর সাথে আমার বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছে কথা হয়েছে কিন্তু তা কখনোই পূর্ব নির্ধারিত ছিলো না। তা ছিলো কোনো অনুষ্ঠানে অথবা দাওয়াতে। কুশল বিনিময় ছাড়া বেশি কিছু আলোচনার সুযোগ থাকতোনা।

ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সাথে একান্তে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ আসে ২০১৭ সালে মে মাসের ৮ তারিখে। পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুযায়ী ধানমন্ডিতে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে তার অফিসে দীর্ঘক্ষণ তাঁর সাথে আলোচনা হয়। তাঁকে আরো কাছে থেকে গভীরভাবে জানতে পারি। জানতে পারি তাঁর অতীত ও বর্তমান কর্মকান্ড ও ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা। সাধারণ মানুষের শিক্ষা-চিকিৎসা সহজলভ্য করার কথা। জীবনমান উন্নয়নের কথা। খাদ্য ও বাসস্থানের নিশ্চয়তা বিধানে উপায়ের কথা। এ বিষয়ে আলোচনাকালে আমরা স্বাধীনতার রূপকার ও বিশিষ্ট রাজনৈতিক দার্শনিক সিরাজুল আলম খান দাদা প্রস্তাবিত একটি আধুনিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার পূর্ণাঙ্গ রূপ রেখা ও তাঁর সংক্ষিপ্ত রূপ চৌদ্দ দফা প্রস্তাবনার কথা তাঁর সামনে উপস্থাপন করি। তিনি এর প্রায় সবকিছুর সাথে সহমত পোষণ করেন কয়েকটি বিষয় ছাড়া। তবে তা বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে তাঁর কিছুটা ভিন্নমত আছে বলে জানান।

ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী আমাদের জানান, সিরাজুল আলম খান দাদা তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং সমবয়সী। ঢাকা মেডিক্যালে পড়াকালিন তিনি ছাত্র ইউনিয়ন করতেন আর সিরাজুল আলম খান ছাত্র লীগ। তখন থেকেই তাঁদের পরিচয় ও বন্ধুত্ব। তাঁরা পরস্পর ভালো বন্ধু।

মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল ছাড়াও ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর দুটি উদ্যোগ আমার খুব ভালো লেগেছে। একটি হলো♦অনগ্রসর নারীদের কর্মসংস্থান ও ক্ষমতায়ন। অপরটি হলো♦জাতীয় ঔষধ নীতি বাস্তবায়নে অগ্রনী ভূমিকা পালন।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রই সম্ভবত প্রথম অথবা অগ্রনী প্রতিষ্ঠান যেখানে নারীদের নিয়োগে প্রাধান্য দেয়া হয় এবং তাদের কর্মচারী নয় কর্মী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিচিত্রার প্রতিবেদনে পড়েছিলাম, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সকল কর্মকর্তা, ডাক্তার, কর্মচারী নারী পুরুষ নির্বিশেষে একত্রে কৃষি কাজ করতেন, ডাইনিং টেবিলে একত্রে দুপুরের খাবার খেতেন ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীসহ। আমাদের দেশে ব্যক্তিগতভাবে অনেক নারীকে গাড়ী চালাতে দেখা গেলেও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নারীরাই সম্ভবত প্রথম যাঁরা ড্রাইভিংকে পেশা হিসেবে নিয়েছে। আমি বহুবছর আগে থেকে দেখে আসছি ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ব্যক্তিগত গাড়ীর ড্রাইভার একজন নারী। শোনা যায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নিয়োগ পাওয়া প্রথম নারী সৈনিকও নাকি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কর্মী ছিলো।

বাংলাদেশে ১৯৮২ সালে প্রণীত ও বাস্তবায়িত ঔষধনীতির অন্যতম নেপথ্য নায়ক ছিলেন ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী। অবশ্য সিরাজুল আলম খান দাদার নেতৃত্বে জাতীয় রাজনৈতিক শক্তিও ঔষধ নীতি প্রণয়নে ও বাস্তবায়নে জোরালো ভূমিকা রেখেছিলো। সেই যুগান্তকারী ঔষধ নীতি বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের আমাদানি নির্ভর ঔষধের বাজার এখন রপ্তানিমুখী ঔষধ শিল্পে পরিণত হয়েছে। এখন বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম ঔষধ উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ পরিচিত। আগে দেশে ব্যবহৃত ৯০℅ ঔষধ আমদানি করতে হতো এবং তার মূল্য ছিলো অত্যধিক। আর এখন দেশের চাহিদার ৯০% ঔষধ দেশেই উৎপাদিত হয়। উপরন্তু রপ্তানি পণ্যের তালিকায় ঔষধ প্রথম কয়েকটির অন্যতম।

করোনা ভাইরাস (COVID-19)এখন বৈশ্বিক সমস্যা :
সৃষ্টির পর পৃথিবীর সর্বত্র একইসাথে এ ধরনের মহামারি আর কখনো দেখা যায়নি। সারা বিশ্ব আজ স্তব্ধ। মানব জাতির ইতিহাসে সম্মিলিতভাবে এমন দূর্যোগের মুখোমুখি আর হতে হয়নি। এর কার্যকর কোনো ঔষধ, টিকা অথবা চিকিৎসা এখন পর্যন্ত আবিস্কৃত হয়নি। পৃথিবীর হাজার হাজার চিকিৎসা বিজ্ঞানী এ রোগের প্রতিষেধক, টিকা ও ঔষধ আবিস্কারে গলদঘর্ম হচ্ছে। এমনকি এ রোগ নির্ণয়ের প্রয়োজনীয় কীট উৎপাদন ও বিপণনেও হিমসিম খাচ্ছে পুরো পৃথিবী। করোনা ভাইরাস নির্ণয়ের কীট এর সংকট ও উচ্চমূল্যের কারনে পৃথিবীর অনেক দেশের মতো আমাদের দেশেও প্রয়োজন ও চাহিদা অনুযায়ী করোনা ভাইরাস পরীক্ষা করানো সম্ভব হচ্ছে না।
এমনি অবস্থায় ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরীর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের একদল বিজ্ঞানী করোনা ভাইরাস নির্ণয়ের কীট আবিস্কার করেন। এবং পরীক্ষা নীরিক্ষার পর তাঁরা এটি অনুমোদনের জন্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট পেশ করেন। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির দূর্বলতার মারপ্যাঁচে পড়ে এই কীট আজপর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি অথবা কার্যকর নয় বলে বাতিলও হয়নি ১৬ জুন পর্যন্ত।

অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে এটাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনায়ও নেয়া হয়নি। আবার এর বিকল্প পর্যাপ্ত ও কার্যকর কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারেনি সরকার। সারাদেশে করোনা ভাইরাসের পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা তো দূরের কথা, রোগ নির্ণয়ের করুণ চিত্র পুরো জাতিকে আতঙ্ক ও হতাশায় নিমজ্জিত করেছে। করোনা ভাইরাস সংশ্লিষ্ট কর্মকান্ড ও আচরণ দেখে মনে হয় সরকারের ভেতরে থাকা সরকারি -বেসরকারি কিছু মানুষ হয়তো ভাবছেন তাঁরা অমর! চিরদিন বেঁচে থাকবেন।

ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী, স্ত্রী-পুত্রসহ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত বেশ কিছুদিন থেকে। অন্যরা বাসায় থাকলেও তিনি গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেও তিনি তাতে সম্মত হননি।
করোনা চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হতে থাকলেও গতকাল তাঁর নিউমোনিয়া সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ডাক্তার জানিয়েছে। তাঁর সর্বশেষ অবস্থা কী তা আমার জানা নেই। আমি ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী সন্তানের করোনা মুক্তি ও সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।

লেখক: জিয়া খন্দকার,
কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক নেতা ও সাবেক ছাত্রনেতা (ভিপি টিএন্ডটি কলেজ,মতিঝিল)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top